ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেড (ইআরএল), দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী উত্তর পতেঙ্গা এলাকায় প্রায় দুইশত দুই একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এর অন্যতম এই অঙ্গ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠাকালের পর থেকে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণপূর্বক দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।
১৯৬০ সালে জনাব আব্বাস খলিলি’র নেতৃত্বে কতিপয় শিল্প উদ্যোক্তা, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশন (EPIDC) এবং যুক্তরাজ্যের বার্মা অয়েল কোম্পানি (BOC) এর যৌথ অংশীদারিত্বে বার্ষিক ১৫ লক্ষ মে. টন পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পেট্রোলিয়াম রিফাইনারী চট্টগ্রামে স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এলক্ষ্যে, ১৯৬৬ সালে ফ্রান্সভিত্তিক TECHNIP, ENSA এবং COFRI নামক তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের সাথে টার্ন-কী চুক্তি সম্পাদিত হয়। সে মোতাবেক, ১৯৬৭ সালে রিফাইনারীর সংস্থাপন কাজ সম্পন্ন হলে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ০৭ মে ১৯৬৮ প্রতিষ্ঠানটি সফলভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীনতাত্তোর ১৭ মে ১৯৭২ ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেড-কে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রদানপূর্বক বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন এর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। পরবর্তীতে, ০১ জানুয়ারি ১৯৭৭ ইআরএল নবগঠিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এর অধীনে ন্যস্ত হয়।
প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময় থেকে সুদীর্ঘ পাঁচ দশকের অধিককালের সফল পথপরিক্রমায় ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেড সর্বোচ্চ গুণগতমান বজায় রেখে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। এলক্ষ্যে, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানিকৃত যথাক্রমে এরাবিয়ান লাইট ক্রুড অয়েল ও মারবান ক্রুড অয়েল পাতন প্রক্রিয়ায় পরিশোধনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য উৎপাদন এবং বিপিসি’র অধীনস্থ বিপণন কোম্পানিসমূহের মাধ্যমে দেশব্যাপী সরবরাহ করা হয়। ইআরএল’এ উৎপাদিত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যসমূহের মধ্যে লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), স্পেশাল বয়েলিং পয়েন্ট সলভেন্ট (এসবিপিএস), মোটর গ্যাসোলিন রেগুলার (পেট্রোল), মোটর গ্যাসোলিন প্রিমিয়াম (অকটেন), ন্যাফথা, মিনারেল টার্পেনটাইন (এমটিটি), সুপিরিয়র কেরোসিন অয়েল (এসকেও), এভিয়েশন টারবাইন ফুয়েল (জেট এ-১), হাই স্পীড ডিজেল (এইচএসডি), জুট ব্যাচিং অয়েল (জেবিও), লাইট ডিজেল অয়েল (এলডিও), ফার্নেস অয়েল (এফও) ও বিটুমিন অন্যতম। ইআরএল’র অপারেশনাল কার্যক্রম দিন-রাত ২৪ ঘন্টা শিফট ভিত্তিক পরিচালিত হয়ে থাকে। বিপিসি’র সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্ত ‘প্রসেসিং ফি’ ইআরএল’র আয়ের মূল উৎস।
ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেড একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। লভ্যাংশ, আয়কর, মূসক ও অন্যান্য করাদি বাবদ প্রতিবছর সরকারি কোষাগারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্র্থ জমাদান এবং প্রায় আট শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অনন্য অবদান রেখে চলেছে। প্রতিষ্ঠানে বিরাজমান সুস্থ শিল্প সম্পর্ক এবং উপযুক্ত কর্মপরিবেশ দেশের প্রেক্ষিতে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক পরিচালনার ফলে অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় পূর্বে স্থাপিত ইআরএল প্ল্যান্টটি এখন পর্যন্ত শতভাগ উৎপাদনক্ষম রয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্।
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ক্রমবর্ধমান বিকাশে জ্বালানির চাহিদাও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা বার্ষিক প্রায় ৭.০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন হলেও ইআরএল এর ক্রুড অয়েল প্রসেসিং সক্ষমতা বার্ষিক ১.৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাত্র। ফলে, বর্ধিত চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে বিপিসি কর্তৃক বিপুল পরিমাণ ফিনিশড্ প্রোডাক্টস আমদানি করতে হয়। এ অবস্থা নিরসনপূর্বক দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ়করণের লক্ষ্যে বার্ষিক ৩.০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন পরিশোধন সক্ষমতাসম্পন্ন ইআরএল’র ২য় ইউনিট স্থাপনের লক্ষ্যে “ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২” শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এলক্ষ্যে, প্রকল্পের অধীনে আধুনিক কারিগরি ডিজাইনসমৃদ্ধ মোট ২১টি প্রসেসিং ইউনিট, প্রয়োজনীয় ইউটিলিটি সার্ভিসেস, স্টোরেজ ট্যাংকসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক ইউরো-৫ মানের পরিবেশবান্ধব মোটর গ্যাসোলিন ও ডিজেল অয়েল উৎপাদন করা সম্ভবপর হবে। তদুপরি, বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকবলের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, উন্মোচিত হবে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত।
আমদানিকৃত জ্বালানি তেল স্বল্প সময় ও স্বল্প ব্যয়ে অধিকতর সহজ ও নিরাপদ প্রক্রিয়ায় খালাস নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত ‘‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন” শীর্ষক প্রকল্পটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এর পক্ষে ইআরএল কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া, বিদ্যমান ম্যানুয়াল গেজিং পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক অটোমেটেড পদ্ধতিতে জ্বালানি তেল পরিমাপ ও সরবরাহ করার লক্ষ্যে “ডিজাইন, সাপ্লাই, ইন্সটলেশন, টেস্টিং এন্ড কমিশনিং অফ কাস্টডি ট্রান্সফার ফ্লো মিটার উইথ সুপারভিজরি কন্ট্রোল এট ইআরএল ট্যাংক ফার্ম” শীর্ষক প্রকল্পের কাজও ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ এবং দুই হাজার চব্বিশে ছাত্র-জনতার বৈষ্যম্যবিরোধী আন্দোলনে অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আজকের নতুন বাংলাদেশ। পরিবর্তনের এই অগ্রযাত্রায় দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত তেল শোধনাগার হিসেবে ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেডও অন্যতম অংশীদার। একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে মানসম্মত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণপূর্বক দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ়করণে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন।
প্রকৌশলী মো: শরীফ হাসনাত
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ইস্টার্ণ রিফাইনারী লিমিটেড